This article was first published at 4numberplatform.com
ববি রমাকান্ত ও সন্দীপ পাণ্ড্যে
এপ্রিলের মাঝামাঝি কোভিড অতিমারিতে ভারতের অবস্থা যখন দুর্বিষহ, যখন প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৪,৫০,০০০ নতুন আক্রান্ত মানুষের নাম নথিবদ্ধ হচ্ছে, তখন কোভিড প্রতিষেধক দান অনুষ্ঠানে চমকপ্রদ কিছু ঘটনারও এক সময়রেখা তৈরি হয় (উত্তরাখণ্ডের কুম্ভমেলা এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য জায়গায় নির্বাচনগুলি আয়োজনের পাশাপাশি)।
গত ১১-১৪ এপ্রিল ২০২১ অবধি ‘টিকা উৎসব’ আয়োজন করার ঠিক পরেই ভারত সরকার বাহবা কুড়ানোর জন্যে ঘোষণা করে দেশের ১৮-ঊর্ধ্ব প্রত্যেকজনকে টিকা দেওয়া হবে। এবং ২৩ এপ্রিল ২০২১ ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক নিজের ‘উদারীকৃত মূল্য নির্ধারণ এবং কোভিড-১৯ জাতীয় টিকাকরণ ত্বরান্বিত কৌশল’ (‘Liberalized Pricing and Accelerated National Covid-19 Vaccination Strategy’) জানায়। যার সুবাদে এই মন্ত্রক ১৮-৪৪ বছরের নাগরিকদের টিকাকরণের দায়টিকে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে। শব্দবন্ধে যে ‘liberalized’ কথাটি রয়েছে, জনগণের জন্য তা অবশ্য প্রযোজ্য নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সুবিধার্থে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। সরকার যে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাজারে নেমেছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বেসরকারি দুই প্রতিষেধক উৎপাদককে রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্যে চড়া দাম হাঁকার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল। কেউ বিশ্বাস করেনি প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের জোরেই দাম বাড়িয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ও সুশীল সমাজের প্রতিবাদ, টিকাকরণে পিছিয়ে যাওয়া এবং সংশোধিত ‘উদারীকৃত’ টিকাকরণ নীতিকে মর্জিমাফিক এবং অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করা সুপ্রিম কোর্টের চাপে সরকার ৮ জুন ২০২১ জাতীয় কোভিড টিকাকরণ অনুষ্ঠানের সংশোধিত গাইডলাইন ঘোষণা করে, যাতে রাজ্যগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে ৭৫ শতাংশ টিকা জোগাড়ের দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তবুও বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্যে ২৫ শতাংশ টিকা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বেসরকারি হাসপাতালগুলির জন্য টিকা দেওয়ার সর্বোচ্চ মূল্য হিসেবে ১৫০ টাকা স্থির করে দেওয়ার পরে তারা ৬০০ টাকায় কোভিশিল্ড, ১২০০ টাকায় কোভ্যাকসিন এবং ৯৪৮ টাকায় স্পুটনিক টিকা সংগ্রহ করতে পারবে। জিএসটি সহ তারা টিকাগুলিকে যথাক্রমে ৭৮০, ১৪১০ এবং ১১৪৫ টাকায় বিক্রি করতে পারবে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হল, টিকা দেওয়ার জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মূল্য ১৫০ টাকা স্থির করে দিলেও টিকা উৎপাদকদের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে আছে, আগে কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন প্রতি ডোজ পিছু ১৫০ টাকা মুল্যে সংগ্রহ করত কেন্দ্রীয় সরকার। তাহলে কেন এখন উৎপাদকদের বাড়িয়ে দেওয়া দামের ঘোষণাকে মেনে নিল সরকার?
অফিস মেমোরেন্ডাম বলছে কোভিড টিকাকরণ কেন্দ্রগুলি যদি বেশি দাম চায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ উৎপাদকেরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী টিকাগুলির দাম কষে নিয়ে তা ঘোষণা করে দিল। বেসরকারি হাসপাতালগুলির প্রতি কঠোর মনোভাবাপন্ন হলেও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার? প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তো হওয়ার কথা ছিল দেশের বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে সামুহিক প্রতিষেধক ক্ষমতা গড়ে তোলা। তাহলে কেন তিনি বেসরকারি সংস্থাগুলিকে টাকা বানাবার পথ করে দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন? পেটেন্ট-এর আওতা থেকে কোভিড ভ্যাকসিনকে মুক্ত রাখবার সমর্থন আদায়ের জন্য জি সেভেন আউটরিচ সামিটে বড় মুখ করে নরেন্দ্র মোদি ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান হেলথ’-এর আবেদন করেন। অথচ নিজের দেশে ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান হেলথ’-এর নীতি কার্যকর করতে ওঁর প্রবল অনীহা।
দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে সীমিত মানুষই টিকা নিচ্ছেন। মে মাসে যে ৭.৪ কোটি টিকা ভারতে ব্যবহার হল, তার মধ্যে ১.৮৫ কোটি টিকাই বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে দেওয়া হয়েছে। সরকারি টিকা দান কেন্দ্রগুলিকে যখন আমরা বন্ধ থাকতে দেখেছি, তখন টিকা নিয়ে বসে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলি মাত্র ২২ লাখ ডোজ দিতে পেরেছে। মোট যে ১.২ কোটি বেসরকারি হাসপাতালগুলি সত্যিই সংগ্রহ করেছিল, তার অর্ধেকটাই বড় শহরগুলিতে অবস্থিত ৯টি বড় হাসপাতাল দখল করে নেয়। বেসরকারি মালিকেরা যাতে লাভ করতে পারে তা স্থির করে দেওয়ার জন্য সরকারের যে অপরাধমূলক যোগসাজশ, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। এর থেকে আরেকটা ব্যাপারও বোঝা যাচ্ছে যে ধনীদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সরবরাহ জারি থাকবে কিন্তু দরিদ্রদেরই সরবরাহের অভাবে ভুগতে হবে। ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান হেলথ’-বলে মোদির আহ্বান শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মানুষদের ভোগের জন্য। অমিত শাহ-র ভাষায় যা ‘জুমলা’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
পক্ষপাতিত্বের আরেকটি প্রকট নিদর্শন হিসেবে সরকার এবার ফাইজার নামে বিদেশি টিকা উৎপাদক সংস্থাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বন্দোবস্তে নেমেছে। আজ অবধি কোনও টিকা উৎপাদক সংস্থাকে এই সুবিধা দেওয়া হয়নি। যদি সব উৎপাদকদেরই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয় তাহলে ভারত বায়োটেক-কেও দিতে হবে, যার বানানো টিকা শুধুমাত্র জরুরিভিত্তিক ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছিল, যেহেতু সেই টিকার তৃতীয় দফার ট্রায়াল এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। টিকাকরণ নীতির প্রয়োগে আনাড়িপনাটি সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিভ্রান্তিকর হচ্ছে। এক দিকে পৃথিবীর অন্য দেশগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত সরকার মানবাধিকার এবং উদ্যোগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমঝোতার জন্য আলোচনা চালাচ্ছে, যাতে বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে তাদেরকে আইনি পথে দায়ী করা যায়, কিন্তু অন্যদিকে এটাই দেখার কর্পোরেট দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে সরকার কি সরাসরি নিজের অবস্থান জানাবে? কর্পোরেট সংস্থাগুলি আমাদের দেশে কীভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে এসেছে, তার নিদর্শনগুলি মানুষ ভুলে যায়নি, যার মধ্যে ১৯৮৪ সালের হৃদয়-বিদারক ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিও অন্তর্ভুক্ত।
বাজারভিত্তিক যে ‘সমাধানগুলি’ চালু আছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা নতুন সমস্যা তৈরি করে), তা অনুসরণ করবার পথ থেকে সরকারকে সরতে হবে। আদৌ যদি সে গরিষ্ঠসংখ্যক অভাবী মানুষদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনে ইচ্ছুক হয়। যেমন ড্রোনের সাহায্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের উদ্যোগটিকে অত্যন্ত সাবধানে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, কারণ মানুষের উপকারের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভ তোলার ইতিহাস এই সংস্থাগুলির আছে। তাছাড়াও, বড় প্রশ্নটি হল যে সবচেয়ে অভাবী মানুষগুলির কাছে এই মৌলিক পরিষেবাগুলি কেন পৌঁছায় না? সব শিশু কেন নিয়মমাফিক টিকাকরণের আওতায় আসে না? যে সংস্থাগুলির উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে আমরা অসুস্থ হই, সেগুলি কেন লাভ করতেই থাকে যখন দেশের মানুষরা সহজ আরোগ্য রোগগুলির মহামারিতে ভোগে? অসুস্থতার থেকে লাভ তোলা কেন মানবসমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে?
২৬ এপ্রিল ২০২১ স্কালে আগ্রার পারস হাসপাতালের মালিক ডাঃ অরিঞ্জয় জৈন এক মহড়ায় অক্সিজেনের চূড়ান্ত অভাবের সম্মুখীন হয়ে ৯৬টি রোগীর জন্যে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এটি দেখবার জন্যে রোগীদের মধ্যে মরণাপন্ন কয়জন আছেন। ২২ জন রোগীকে চিহ্নিত করা হয় যাদের শরীর অক্সিজেন না পেয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে। বাকি ৭৪ জন পরিবেশ থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণে সমর্থ। পরের ২ দিনের মধ্যে ৭ জন রোগীর মৃত্যু হয়। জেলা প্রশাসন ৫৫ জন রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে পরবর্তী তদন্ত চালানোর জন্যে হাসপাতালটিকে সিল করে দেয়। নিস্পাপ সাদাসিধে সেজে ডাঃ অরিঞ্জয় জৈন নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং জীবনের সবচেয়ে বড় নিরীক্ষণ চালানোর কথা স্বীকার করে নেন। তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলিতে এবং অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে ভর্তি হবার জন্য অপেক্ষারত রোগীদের অবহেলার কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে কাকে/কাদের দায়ী করা হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০১৭ সালে যখন অক্সিজেনের অভাব এমন প্রকট নয়, তখন পাওনা টাকা না চুকিয়ে দেওয়ার কারণে গোরখপুরের বিআরডি হসপিটালে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেই দোষে হাসপাতালের এনসেফেলাইটিস ওয়ার্ডে নোডাল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ডাঃ কাফিল খান চাকরি হারান, বিভাগীয় তদন্তে যে আরোপ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সেই কাণ্ডে ৭০টি শিশু প্রাণ হারায়। যদি শাস্তিদানই এই অব্যবস্থার উত্তর হয় তাহলে এবারের মৃত্যুর ব্যাপকতার জন্য বেশ কিছু মানুষের শাস্তি এবং তার সঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা, এমনকি গোটা সরকারকেই দায়ভার এড়াবার দোষে সিল করা উচিত।